, রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫ , ১৫ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

​সাইবার হ্যাকিং থেকে টার্গেট কিলিং: বিশ্বজুড়ে ইসরায়েলের যত গোপন গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক

  • আপলোড সময় : ১৭-০৬-২০২৫ ১১:০৯:৩৩ পূর্বাহ্ন
  • আপডেট সময় : ১৭-০৬-২০২৫ ১১:০৯:৩৩ পূর্বাহ্ন
​সাইবার হ্যাকিং থেকে টার্গেট কিলিং: বিশ্বজুড়ে ইসরায়েলের যত গোপন গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক প্রতিকী ছবি।
 
ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে বৈরুতে ড্রোন হামলা—বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত মোসাদ, শিন বেট ও ইউনিট ৮২০০-এর কার্যক্রম যেন বাস্তবের গুপ্তচর উপন্যাস।

ধারণা করা হয় বিশ্বের প্রায় প্রতিটি কূটনৈতিক সংকটে সরব অথবা নীরবভাবে জড়িয়ে থাকে এক রাষ্ট্রের নাম—ইসরায়েল। তবে অধিকাংশ সময়ই সরাসরি সামরিক অভিযানের আগে ঘটে এক ধাপ গোপন, নিঃশব্দ ও রহস্যময় ঘটনা। বিদেশের মাটিতে শত্রুর গোপন হত্যাকাণ্ড, স্যাটেলাইট ও সাইবার পর্যবেক্ষণ, রাজনৈতিক চরবৃত্তি কিংবা শত্রু ঘাঁটিতে অদৃশ্য বিস্ফোরণ—সবকিছুতেই বারবার উঠে আসে একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্কের নাম-ইসরায়েলের গোয়েন্দা ইউনিটগুলো। তাদের কার্যক্রম কখনো প্রকাশ্যে নয়, তবে প্রতিবারই ফলাফল হয় বিস্ময়কর।

২০২৫ সালের জুন মাসে তেহরানে ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রাণঘাতী হামলার দিনেই স্পষ্ট হয়, ইসরায়েলি গোয়েন্দা ইতিহাসে এ যেন আরেক অধ্যায় । শুধু রকেট নয়, এই যুদ্ধ একান্তই তথ্যের, ছায়ার, এবং আধুনিক প্রযুক্তির। প্রশ্ন জাগে—ইসরায়েল কীভাবে এতদূরে গিয়ে এমন নিখুঁত আঘাত হানে? কীভাবে নির্ভুল টার্গেট চিহ্নিত করে তা নিঃশব্দে ধ্বংস করে?

ইসরায়েল ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও তাদের গোয়েন্দা নজরদারির ভিত্তি আরও পুরনো। ব্রিটিশ শাসনামলে ‘শাই’ নামের একটি গোয়েন্দা ইউনিট ছিল যা ছিল ইহুদি আধা-সামরিক সংগঠন 'হাগানাহ'-এর গোয়েন্দা শাখা। এটি ইহুদি নিরাপত্তার প্রথম স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত হতো। এই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গঠিত হয় তিনটি শক্তিশালী গোয়েন্দা বাহিনী—মোসাদ, শিন বেট (শাবাক), এবং আমান।
 
বিশ্বব্যাপী অপারেশনে মোসাদ
১৯৪৯ সালে গঠিত মোসাদ ইসরায়েলের বিশ্বব্যাপী গোয়েন্দা কার্যক্রমের মূল চালিকাশক্তি। এই সংস্থার কাজ শুধু তথ্য সংগ্রহই নয়, বরং সেই তথ্যের ভিত্তিতে সরাসরি আক্রমণ পরিচালনা করা। বহির্বিশ্বে রাজনৈতিক হত্যা, গুপ্তচর নিয়োগ, নাশকতা কিংবা কৌশলগত হস্তক্ষেপ—সবকিছুতেই মোসাদের পেছনে থাকায় সন্দেহ থাকে না কারও।

ইরানের শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফখরিজাদেহ হত্যাকাণ্ডে যেমন মোসাদের ভূমিকার কথা জোরেশোরে আলোচনা হয়, তেমনি ২০২৪ সালে বৈরুতে হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহর বিস্ফোরণে মৃত্যু কিংবা ২০২৩ সালের ড্রোন হামলায় হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়ের নিহত হওয়ার ঘটনা—সব কিছুতেই মোসাদের ছায়া রয়েছে গভীরভাবে।

বিশ্বজুড়ে রয়েছে মোসাদের এজেন্ট, যারা কখনো কূটনৈতিক আড়ালে, কখনো মানবিক সংস্থার ছদ্মবেশে বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে।
 
অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ছায়ারক্ষী শিন বেট (শাবাক)
ইসরায়েলের ভেতরের নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত গোয়েন্দা সংস্থা শিন বেট, যার আরেক নাম শাবাক, কাজ করে গাজা, পশ্চিম তীর ও জেরুজালেমে সন্ত্রাসবাদ, আত্মঘাতী হামলা ও রাজনৈতিক হুমকি ঠেকাতে। যেখানে মোসাদ কাজ করে বিদেশে, সেখানে শিন বেট দেশের ভেতরে। নিজেদেরকে তারা বলে ‘ইসরায়েলি জনগণের অদৃশ্য ঢাল’।

তথ্য সংগ্রহে তারা ব্যবহার করে প্রযুক্তি ও মানব গোয়েন্দা (Humint)। সন্দেহভাজনদের অনুসরণ, অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র নজরে রাখা ও তাদের দৃষ্টিতে চরমপন্থীদের প্রতিরোধে তারা ছায়ার নিচে থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
 
সামরিক গোয়েন্দার কারিগর আমান
‘আমান’ বা মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স ডিরেক্টরেট মূলত ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর অধীনস্থ। তাদের সবচেয়ে আলোচিত ইউনিট তিনটি—৮২০০, ৯৯০০ এবং ৫০৪।

এই ইউনিটগুলো বিশেষভাবে কাজ করে নির্দিষ্ট টার্গেট শনাক্ত, সাইবার পর্যবেক্ষণ, স্যাটেলাইট নজরদারি, তথ্য বিশ্লেষণ এবং আক্রমণের স্থান নির্ধারণে।
 
ডিজিটাল যুদ্ধে অদ্বিতীয় ইউনিট ৮২০০
যদি মোসাদ হয় ‘তলোয়ার’, তবে ৮২০০ হলো ইসরায়েলের ‘কম্পিউটার মস্তিষ্ক’।

এটি ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় গোয়েন্দা ইউনিট, যেখানে প্রায় ১০,০০০ অভিজ্ঞ প্রযুক্তিবিদ, হ্যাকার, অ্যানালিস্ট এবং সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ কাজ করেন। এই ইউনিট ইলেকট্রনিক আড়িপাতা, সিগন্যাল ডিকোডিং, সাইবার হুমকি প্রতিরোধ, এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে গুপ্তচর তথ্য সংগ্রহের মতো দায়িত্বে নিয়োজিত।

২০১০ সালে ইরানে ‘স্টাক্সনেট’ ভাইরাস দিয়ে পারমাণবিক কেন্দ্র ধ্বংসের পেছনেও ছিল এই ইউনিট। বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের এনএসএ-এর পর বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট এটি। ২০২৫ সালের জুনে ইরানের জাতীয় রেডিও ও টিভি চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচারে বিঘ্ন ঘটানোর ঘটনায়ও হ্যাকিংয়ের ইঙ্গিত মেলে। ইরানের সরকারি বার্তা সংস্থা আইআরএনএ জানায়, জাতীয় রেডিও ও টেলিভিশন সংস্থা আইআরআইবি’র সূত্র বলছে—নিউজ নেটওয়ার্কের প্লেআউট হ্যাকিংয়ের ফলেই এ বিঘ্ন ঘটে।
 
স্যাটেলাইটে অভিযানে ইউনিট ৯৯০০
চোখ যেখানে পৌঁছায় না, সেখানে ৯৯০০ পৌঁছে যায় স্যাটেলাইট ও ড্রোনে। এই ইউনিট চিত্র ও মানচিত্র বিশ্লেষণের মাধ্যমে যুদ্ধ পরিকল্পনা করে দেয়। নগর এলাকায় সেনা পাঠানোর আগে তিন মাত্রিক মানচিত্র তৈরি করে সেনাবাহিনীকে সহায়তা করে।

ইরানের ওপর সাম্প্রতিক নজরদারিতে ‘হরাইজন ১৩’ স্যাটেলাইট ব্যবহার করে তারা সফলভাবে একাধিক ঘাঁটি শনাক্ত করেছে।

২০২০ সালে এই ইউনিটের ভেতর আরও একটি সাব-ইউনিট গঠন করা হয় যা স্পেশাল ড্রোন গোয়েন্দা কার্যক্রমে নিয়োজিত।

মানুষের গোপন তথ্য সংগ্রহে ইউনিট ৫০৪
‘হিউম্যান ইন্টেলিজেন্স’ বা হিউমিন্ট হচ্ছে ৫০৪-এর কাজ। তারা মোসাদ বা শিন বেটের সঙ্গে একত্রে কাজ করে গাজা, লেবানন এবং এমনকি ইউরোপেও তথ্য সংগ্রহ করে থাকে।

শত্রুপক্ষের ঘাঁটিতে অনুপ্রবেশ, স্থানীয়দের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ, এবং কখনো কখনো ঘুষ দিয়ে তথ্য পাওয়া এদের কাজের অঙ্গ। ৭ই অক্টোবরের হামলার পর এই ইউনিট সরাসরি গাজার ফ্রন্টলাইনেও সক্রিয় রয়েছে।

ভবিষ্যতের যুদ্ধের পরিকল্পনায় ব্রাঞ্চ ৫৪
২০২৩ সালে গঠিত এই নতুন ইউনিট ইরানের বিপ্লবী গার্ড ‘পাসদারান-ই-ইনকিলাব’-এর বিরুদ্ধে সম্ভাব্য যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।

এর বর্তমান কমান্ডারের নাম কোনো অফিসিয়াল সূত্রে প্রকাশ করা হয়নি। ইসরায়েলি মিডিয়ায় এবং সরকারি পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, এ ইউনিট সদস্যের সংখ্যা কম (সংবাদ অনুযায়ী প্রায় ৩০ জন) ও পরিপূর্ণ গোপনীয়তার সঙ্গে পরিচালিত হয়, যার ফলে এর নেতৃত্বের পরিচয় সামনে আসে না ।
এই ইউনিটের কাজ হলো ইরানের আণবিক ও সামরিক ঘাঁটিগুলো চিহ্নিত করা, প্রতিদিন নতুন টার্গেট শনাক্ত এবং সে অনুযায়ী তথ্য বিশ্লেষণ করে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর জন্য উপযোগী পরিকল্পনা তৈরি করা।
 
ইসরায়েলের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক মূলত বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় কয়েকধাপ এগিয়ে আছে। তারা শুধু প্রতিরক্ষা নয়, আক্রমণেও এই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে। প্রযুক্তি, মানুষ, আর কৌশলকে একসাথে মিশিয়ে তারা শত্রুকে আঘাত করে এমনভাবে—যেখানে সময় পেরিয়ে গেলেও প্রতিদ্বন্দ্বী ঠিক বুঝে উঠতে পারে না কীভাবে হামলা হলো।

বিশ্বজুড়ে চলমান ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনার ছায়া যখন গভীরতর হয়, তখন পরিষ্কার হয়ে ওঠে—ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো শুধু গোপনেই নয়, গোটা যুদ্ধনীতি নিয়ন্ত্রণেও প্রভাব ফেলছে।



তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা

নিউজটি আপডেট করেছেন : নিজস্ব প্রতিবেদক

কমেন্ট বক্স
প্রতিবেদকের তথ্য

সর্বশেষ সংবাদ
বাংলাদেশের সামুদ্রিক ভবিষ্যৎ কি পেশাগত মানহানির পথে হাঁটছে?

বাংলাদেশের সামুদ্রিক ভবিষ্যৎ কি পেশাগত মানহানির পথে হাঁটছে?